যখনের কথা বলতে চলেছি তখন যদিও এই বিশেষ শব্দকোষ টির সাথে আমার বিশেষ পরিচিতি ছিলনা| আর যখন সত্যি সত্যি পরিচয় হবার সুযোগ হল তখন বুঝলাম শিশুমনের অবুঝ সরলতা আর নেই| আজ যখন ঠিক ৭ দিন বাদে দেবী দুর্গার আবাহনের প্রস্তুতিতে দিকে দিকে সারা পরে গেছে, আমার মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে সেই দিনগুলো - ছেলেবেলার| যদিও এখন এই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে আসা জীবনে পুজোর সেই অতি-উদ্দীপনা কোথাও গিয়ে নেই বললেই চলে, কিন্ত এখনও পুজো আসলেই বারে বারে মনে পরে যায়ে ছেলেবেলার কিছু টুকরো ছবি|
আমার মনে আছে আমাদের পুরনো বাড়ির সদর দরজার ঠিক সামনে ছিল একটা বহু পুরনো শিউলি গাছ, যেটা আমাদের ছাদের উপর এলিয়ে পরত ফুলের ভারে| আমি বুঝে যেতাম পুজো আসছে যখন আমার রাত জাগা স্বচ্ছ্ব গাঢ় নীল আকাশ ছেয়ে যেতো অগুনতি তারায়, পাড়ার মোড়ের ছাতিম গাছের এক নেশা ধরানো গন্ধ ছেয়ে যেতো বহু দূর, আর আমার প্রিয় ছাদের আলসের উপর খসে পরত একটা দুটো শিউলি, আমি বুঝতে পারতাম মায়ের আবাহন আর বেশি দূরে নয়, মনে মনে যেন শুনতে পারতাম আগমনীর সুর| খুব ছোট্ট বয়স থেকেই আমার খুব প্রিয় জায়গা ছিল আমার দোতলার ঘরের লাগোয়া মস্ত বড় ছাদ| আর কেমন করে বেশ ওই ছাদ, ছাদে লাগানো বা আপনা থেকে বেড়ে ওঠা ফুলের চাড়া বা তেলকুচো লতা, আকাশ ভরা তারা এদের সাথে আমার বেশ ভাব হয়ে গেছিল| তাই আমার বড় হয়ে ওঠার দিনগুলোর সব গোপন কথাই এরা জানে বাকি সবার থেকে বেশি|
যাক সেসব কথা, ফিরে আসি দূর্গা পূজা প্রসঙ্গে| বাকি সবাই যখন বন্ধুদের থেকে খবর পেত পুজো আসছে, আমায় ওই নীল আকাশের গা থেকে টুপ করে খসে পরা তারারা জানিয়ে যেতো মা এর আগমন বার্তা| সে যাই হোক, প্রত্যেক মহালয়ার খুব ভোরে কী এক বিস্ময়কর ভাবে আমার গভীর ঘুম ভেঙ্গে যেতো, আর এক দৌড়ে ছাদে গিয়ে দেখতাম আলশে ভরে গেছে সদ্য ফুটে ঝরে পরা অসংখ্য শিউলি ফুলে| গোটা আলশেটা যেন সাদা ফুলের বিছানা| সে এক অদ্ভূত অনুভূতি ছিলো| কেন জানিনা মনে হত ঠিক সেই মুহুর্তে দাড়িয়ে যে গোটা পৃথিবীটা ভরে উঠেছে এক সুনির্মল মন ভালো করা বাতাসে, ময়লার কোনো কালিমা এক ফোঁটাও আর বাকি নেই কোথাও| ভারী স্নিগ্ধ লাগতো ওই পরিবেশটা, ভোরের প্রথম আলোর রেখা তখন সদ্য সদ্য স্পর্শ করতে শুরু করেছে রাতের আকাশকে, পাড়ার কয়েকটা বাড়ি থেকে ভেসে আসা উদাত্ত গলায় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র-র মহিষাসুরমরদিনী পাঠ, আর আমার সামনে শিউলির গালিচা! প্রকৃতির এই অদ্বুত রূপ-রস-গন্ধর মন প্রাণ ভরে আঘ্রাণ নিয়ে ঘরে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পরতাম আবার, বাকিরা তখন টিভি-তে মহালয়া দেখতে বসতো|
এমন করেই পুজোর চারদিন কেটে যেত কোন এক ঘোরের মধ্যে দিয়ে| দশমীর দিন ছিল আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন কারণ খুব ছোট্টবেলা থেকে বাবার হাত ধরে পাড়ার ঠাকুর বিসর্জন দিতে যাওয়াটা প্রায় একটা রীতি হয়ে গেছিল| বিকেল পড়তে না পড়তেই সবাই লাইন দিয়ে প্রতিমা বরণ করতো, আর আমি মা-এর পায়ে সব বই-পেন-পেন্সিল ঠেকিয়ে (তখনও নাস্তিক হইনি কিনা তাই), সবার মালা থেকে জোগাড় করা এক মুঠো ফুল হাতে নিয়ে এক কোণে দাড়িয়ে তাই দেখতাম মন দিয়ে| আর প্রতিবারই দেখতাম মাটিতে নামানোর পর মা দুর্গার দুচোখ ভরে উঠত জলে| শুধু দুর্গা বললে ভুল বলা হবে, দুর্গা, লক্ষ্মী, কার্তিক, গণেশ - সবার চোখই যেন ছলছল করতো|
মায়ের এই সজল নয়ন আর কেউ দেখতে পেত কিনা তাও বুঝতে পারতামনা, শুধু এটুকু বুঝতে পারতাম যে আমার চোখ দুটোও কখন যেন ভিজে উঠেছে নিঃশব্দে| ছোট্ট বলে দুর্গার গাড়িতে চেপে ঘাট অবধি যাওয়ার এবং ফেরার কড়া নিয়ম ছিল, কেবল বিসর্জন দেখার সময় বাবা বা কোনো পাড়াতুতো কাকু বা মামার হাত ধরে ঘাটের একটা উঁচু সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়াতাম| এই গোটা পথ আমার নজর থাকতো মা এর জলভরা দুচোখে, সে এক ভারী মনখারাপ করা ব্যাপার| প্রতিমা জলে ফেলে দেওযার পর আমি লোকের ভীড়ের মাঝ দিয়ে অনেকটা নীচের সিঁড়িতে দৌড়ে নেমে যেতাম আর দেখতে পেতাম মা এর চোখের জল ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে গঙ্গার ঘোলা জলে|
তারপর একদিন ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলো সব| তবে মায়ের চোখের জল হারিয়ে গেলো না আমার Innocence সেটা আজও বুঝতে পারলাম না ঠিক করে...
No comments:
Post a Comment